কারাগারে খামারী: খেতে না পেয়ে মরছে গরু

প্রকাশিত : মে ২৮, ২০২৩ , ১০:৫৯ অপরাহ্ণ

আশরাফুল ইসলাম, নিজস্ব প্রতিনিধি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ব্রডকাস্টিং নিউজ কর্পোরেশন: দশ বছর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে গড়ে উঠেছিল মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা নামে একটি অনিবন্ধিত এনজিও। ইতিমধ্যে জেলায় প্রায় ৪৪ টি শাখা কার্যালয়েরও উদ্বোধন করেছিলেন তারা। এমনকি বিশাল আঁকারের ডেইরী গরুর খামারও ছিল তাদের। যা থেকে প্রতিদিন প্রায় ৮-১০ মণ দুধ বিক্রি হত। কিন্তু গত বছরের ১৭ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো.মাসুদ রানাকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। এতেই বাঁধে বিপত্তি। খামারে থাকা প্রায় ২৫০ টি গরু এতে অসহায় হয়ে পড়ে। এমনকি কয়েকটি গরু না খেয়ে মারাও গিয়েছে। আর অন্য গরুগুলোর অবস্থাও অত্যন্ত খারাপ। খেতে না পেয়ে কঙ্কাল হয়ে যাচ্ছে।
সরজমিনে জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট শিবনারায়নপুর এলাকার মধুমতি মধুমতি ডেইরী খামারে গিয়ে দেখা যায়, এখনও খামারে রয়েছে হলস্ট্রিন ফ্রিজিয়ান জাতের বিশাল-দেহী গাভী। কিন্তু খামারে থাকা বেশিরভাগ গরু ও বাছুরের চোখের কোনে গড়িয়ে পড়ছে পানি। দেখে মনে হচ্ছে, সবগুলো গরু কোন বিশেষ রোগে আক্রান্ত। খামারে মানুষ প্রবেশ মাত্রই হাম্বা হাম্বা শব্দে মুখরিত করছে পুরো এলাকা। গরুগুলোর পেটের পাশ দিয়ে সুস্পষ্ট দেখা মিলছে হাঁড়ের। উন্নত জাতের এসব গরুর সাথে এমন বৈশিষ্ট্য দেখে হতাশ হবেন যে কেউ। খাবার না পেয়ে গরুগুলোর এ অবস্থা হয়ে বলে দাবি স্থানীয়দের। আগে ওই মধুমতি খামারে ১৬ জন শ্রমিক কাজ করলেও ।এখন মাত্র রয়েছেন তিনজন। তবুও বেতন পাচ্ছেন না তারা। মধুমতি ডেইরী খামারের শ্রমিক আব্দুল বারী বলেন, গত ৫ বছর যাবক এই খামারে আমি কাজ করি। কোন দিন বেতন পায়নি এমন হয়নি। তবে মালিক আটকের পর বেতনের টাকা না পেয়ে ১৬ জন শ্রমিকের মধ্যে ১৩ শ্রমিক চলে গেছে। আমরা মাত্র তিনজন রয়েছি এখানে। গরুগুলোর অবস্থা দেখে ছেড়ে যেতে পারিনি। তাই কষ্ট করে আছি। তবে মনে হচ্ছে আর থাকতে পারবনা। কারণ আমারও তো সংসার আছে। কি দিয়ে চালাব আমার সংসার বেতন পায়নি ৬ মাস থেকে। এদিকে গরুগুলোকে খাবার দিতে পারছিনা। না খেয়ে মরে যাচ্ছে গরু। তাদের কষ্টও দেখতে পারছিনা। খামারে থাকা পাঁচটি গরুকে নিজ হাতে মাটি দিয়েছেন খামারের শ্রমিক আশিক আলী। তিনি বলেন, নিজ হাতে গুরু গুলো বড় করে নিজে গরুকে খাবারের অভাবে মরতে দেখার কষ্ট বলে বোঝাতে পারব না। শুধু গরু নয়, গাড়লগুলোও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। যেসব গরু-গাড়লকে দৈনিক ১২ রকমের দানাদার খাবার দিতাম এখন তার কিছুই পারিনা। গরুর চোখের পানি দেখে নিজের পানিও বের হয়ে যায়। এমন কষ্ট দেখে ছেড়ে যেতে পারিনি এই খামার। আলমগীর নামে আরও এক শ্রমিক বলেন, গত ৫ বছর থেকে আমি মধুমতি ডেইরী খামারে কাজ করি। কিন্তু গত এক বছর আগে গো-খাদ্য কাটতে দিয়ে আমার হাত কেটে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। এসময় মালিক মাসুদ রানা বলেছিলেন, আমাকে ঘর বাড়ি করে দিবেন। কিন্তু সে আর হয়ে উঠল না। তার আগেই তিনি কারাগারে চলে গেলেন। এখন ঘর বাড়ি তো দূরের কথা আমি নিজেই খেতে পাচ্ছিনা। এমনকি গরুগুলো থেকে পাচ্ছেনা। এদিকে মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থায় টাকা জমা রেখে ভোগান্তিতে পড়েছেন ৩৫ হাজার গ্রাহক। টাকা না পেয়ে অসহায় হয়ে রাস্তায় ঘুরছেন অনেকে। দফায় দফায় আদালতে মামলা, সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, সমাবেশ, প্রশাসনের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করেও তারা পাচ্ছেন না কোন সুরাহা। গ্রাহকদের দাবি, এক লাখ টাকায় মাসে ১২০০ টাকা লাভ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমানত সংগ্রহ করে মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা। মাসুদ রানা থাকা পর্যন্ত কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকলেও হঠাৎ করেই অস্ত্রসহ আটকের পর সবকিছু থমকে যায়। তাই গ্রাহকদের দাবি মাসুদ রানাকে কারাগার থেকে বের করা হউক। তাহলে হয় তারা টাকা পাবেন। অন্যদিকে, খামার মালিক ও অনিবন্ধিত এনজিও মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ রানার বাড়ির সামনে প্রতিদিন শতশত মানুষ জমায়েত হচ্ছেন পাওনা টাকা নেয়ার দাবিতে। জানা যায়, মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার জেলা-জুড়ে প্রায় ৪০টির অধিক শাখায় ৩৫ হাজার গ্রাহকের প্রায় ১০৫ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে। এসব টাকায় ট্রাকের ব্যবসা, বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য উৎপাদন ও বাজারজাতসহ খামার স্থাপন করেন, এমডি মাসুদ রানা। কিন্তু তিনি কারাগারে যাওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় জেলা-জুড়ে থাকা মধুমতির বেশিরভাগ শাখাগুলো। শিবনারায়নপুর গ্রামের মো. হেলাল নামে এক মধুমতির গ্রাহক বলেন, আমরা জানি মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার এমডি মাসুদ রানা। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বশীল আরও অনেকেই ছিলেন। যেকোনো কারনে মাসুদ কারাগারে রয়েছে তার মানে কি, সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে? এটা কোন কথা? জনগণের কোটি কোটি টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার এরিয়া ম্যানেজার তানভীর আলী বলেন, সব কিছু ভালোই চলছিল ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ রানা আটকের পর তার স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাহমুদা খাতুনের উচিত ছিল সকল দায়িত্ব নেয়ার। কিন্তু তিনিও পলাতক রয়েছে, মাসুদ রানা আটকের পর থেকেই। আমরা এখন অপেক্ষায় রয়েছি, মাসুদ রানা ফিরে আসার। কিন্তু তিনি আসছেন না। তাহলে কি আমরা ভেবে নি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ রানা। শিবগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: শাহদাৎ হোসেন বলেন, না খেয়ে গুরু মরে যাচ্ছে এমন খবর আমার জানা ছিলনা। আপনি বললেন আমি তাদের খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নিব। তারা আমাকে জানাতে পারত বিষয়টি। এবিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম সাহিদ জানান, মধুমতির প্রতারণার বিষয়ে আদালতে মামলা চলমান। কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেফতারের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। বিষয়টি যেহেতু প্রতারণার, তাছাড়া আদালতে মামলা চলছে। এনিয়ে পুলিশের তেমন কিছু করার নেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক একেএম গালিভ খাঁন বলেন, কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখার আগে অবশ্যই আগে খোঁজ-খবর নিতে হবে। এবিষয়ে জনসাধারণের মাঝে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এছাড়াও মধুমতির বিষয়ে আদালতে কয়েকটি মামলা চলমান রয়েছে। আদালত নির্দেশনা দিলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

[wps_visitor_counter]