বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি শীর্ষক মতবিনিময় সভা

প্রকাশিত : জানুয়ারি ৩১, ২০২৪ , ৬:০১ অপরাহ্ণ

ঢাকা, ব্রডকাস্টিং নিউজ কর্পোরেশন: বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি শীর্ষক জাতীয় পর্যায়ের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার (৩১ জানুয়ারি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ) কাপেং ফাউন্ডেশনের আয়োজনে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সিবিসিবি সেন্টারে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। ফাল্গুনী ত্রিপুরার সঞ্চালনায় ও কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমার সভাপতিত্বে উক্ত সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার রাজা দেবাশীষ রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সমন্বয়ক অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সচিব সেবাস্তিন রেমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সাধারণ সম্পাদক ডা. গজেন্দ্রনাথ মাহাতো, গবেষক ও লেখক পাভেল পার্থ প্রমুখ। প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত থেকে বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরেন পাহাড় ও সমতল অঞ্চলের আদিবাসী নেতৃবৃন্দ। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের মনজুনি চাকমা। মনজুনি চাকমা তাঁর উপস্থাপনায় মূলত ২০২৩ সালে বাংলাদেশে আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরেন। এতে তিনি উক্ত বছরে আদিবাসীদের উপর সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাসমূহের পরিসংখ্যান ও কার্যকারণগুলো বিশ্লেষণ করেন। তিনি তার উপস্থাপনায় বলেন-ভূমি সংক্রান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে ৩৫টি। এর মধ্যে ১৭টি সমতল অঞ্চলে ও অপর ১৮টি ঘটনা ঘটেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। আদিবাসী নারীদের প্রতি সহিংসতার ২৩টি ঘটনায় ২৪ জন আদিবাসী নারী সরাসরি ভুক্তভোগী হয়েছে। চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন-পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশের অন্য অঞ্চলে যে আইন প্রযোজ্য হয় এখানে তা হয় না ১৯০০ সালের রেগুলেশন অনুসারে। সাধারণ আইন বানায় রাষ্ট্র, প্রথাগত আইন বা প্রথা-রীতি বানাই সাধারণ মানুষ। বিগত দুটো মামলা রায় দিয়ে সরকার আমাদের প্রথা-রীতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় এমন কাজে অবস্থান নেয়া মানে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া যেহেতু এ চুক্তি সরকার স্বাক্ষর করেছে। পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়নের সাথে বাংলাদেশের বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ১৯০০ সালের রেগুলেশন নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হচ্ছে। একটি পক্ষ চাই না পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীরা তাদের প্রথা-রীতি অনুসারে তাদের অধিকার ভোগ করুক। ১৯০০ সালের রেগুলেশন অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে বিশেষ শাসন ব্যবস্থা এটা বলবত রাখার জন্য আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে। লাংকম, কার্বারী বলেন-আমি লামা থেকে এখানে অংশগ্রহণ করতে এসেছি লামা রাবার ইন্ড্রান্ট্রিজ কর্তৃক আমাদের মানবাধিকার হরণের বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো তুলে ধরার জন্য। আমাদের সবকিছু ছিল, আম বাগান, কলা বাগান, গাছ বাগান সব কিছুই ছিল। কিন্তু লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ এখানে আসার পর সবকিছু নাই হয়ে গেছে। তারা আমাদের আম বাগান, গাছ বাগান ইত্যাদি আগুন দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। ব্যবসায়িকভাবেও হয়রানি করছে। জুমচাষও করতে পারছি না । আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আমরা অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমাদেরকে হয়রানি করা হচ্ছে। প্রভাবশালী মহল প্রতিনিয়ত আমাদেরকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক বলেন – সরকারের সুফল প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা হয়, হচ্ছে। এয়ার ফোর্সেও ফায়ারিং রেঞ্জ তারা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তারা সেই এলাকায় বেড়া দিচ্ছে। আমরা ভয়ে আছি যে আমাদের এলাকাও দখল হবে কিনা। নেত্রকোনায় আদিবাসী এলাকায় বালু উত্তোলন নির্বিচারে হচ্ছে। এমতাবস্থায় নদীর পাড় ভাঙন হচ্ছে এবং আদিবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
উত্তরবঙ্গের প্রতিনিধি বিষুরাম মুম বলেন,- আদিবাসীদের ভূমিকেন্দ্রিক সমস্যা বারবার ঘটতেই চলেছে। গতবছর একটা ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। মিথ্যা মামলা, নানা ষড়যন্ত্র করা হয় যখন আমরা প্রতিবাদ করতে যায়।
আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক পার্লামেন্টারি ককাসের সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মেসবাহ কামাল- রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আদিবাসীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। এত নিপীড়ন-নির্যাতন হওয়া সত্ত্বেও আদিবাসীরা টিকে রয়েছে। আশা করছি তারা তাদের লড়াই-সংগ্রামে জয়ী হবেন। লড়াই করে টিকে থাকতে হবে। আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। মানুষকে নিশ্চিহ্ন করার পথ বন্ধ করতে হবে। অনেক রক্তের বিনিময়ে হলেও অধিকার অর্জিত হয় এটা মনে রাখতে হবে। আমাদের দেশে আমরা একদিন সূর্যের ভোর দেখবো। রাষ্ট্রের একাংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ তুলে দেয়ার যে ষড়যন্ত্র করছে তা খুব লজ্জাজনক। আমি এটার বিরোধিতা করি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অতিদ্রুত পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।
লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন- গাইবান্ধায় যে ইপিজেড প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে তা বড় ধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং এটি প্রতিবেদনে আসা উচিত। মধুপুরের কৃত্রিম লেক বিষয়টাও আসা উচিত। উত্তরবঙ্গে সেচের পানির জন্য আদিবাসীদের প্রাণ বিসর্জন দিতে হচ্ছে। সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, একসঙ্গে চা বাগান-রাবার বাগান ও আদিবাসীদের হাসি দেখতে চাইবে কিনা। তবে আমি বলি- একসঙ্গে দুটো জিনিস পাওয়া যাবে না। সরকারকে ঘোষণা দিয়ে তার নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে যে এই এই প্রকল্পে আদিবাসী উচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী। বাংলাদেশ বিগত বিভিন্ন প্রকল্পে সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সচিব সেবাস্তিন রেমা বলেন- রাষ্ট্র জনগণের মানবাধিকার রক্ষা করে ও প্রতিষ্ঠিত করে। বিভিন্ন কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়। বিভিন্ন সময় মানবাধিকার প্রতিবেদন হয় কিন্তু আলোর মুখ দেখে না। অনেক সময় বিচারের বানী নিভৃতে কাঁদে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কাজ করার চেষ্টা করছে। আমরা রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের সঙ্গে কাজ করছি, কথা বলছি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য আমরা একটা প্রতিবেদন তৈরি করেছি। এটা যথা-শীঘ্রই যথাযথ ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পৌছিয়ে দেয়া হবে। ওই আলোচনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আদিবাসীরা অংশগ্রহণ করেন। এতে তাদের এলাকার মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরেন। সংবাদ বিজ্ঞপ্তির।

[wps_visitor_counter]