জাতীয় সংবিধান দিবসে প্রধানমন্ত্রীর বাণী

প্রকাশিত : নভেম্বর ৩, ২০২৩ , ৫:০৮ অপরাহ্ণ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সংগৃহীত চিত্র।

ঢাকা, ব্রডকাস্টিং নিউজ কর্পোরেশন: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার জাতীয় সংবিধান দিবসে উপলক্ষ্যে নিম্নোক্ত বাণী প্রদান করেছেন :
“জাতীয় সংবিধান দিবস উপলক্ষ্যে আমি দেশের সকল নাগরিককে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দীর্ঘ তেইশ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও নয় মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র এগারো মাসের মধ্যে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত হয়েছিল বাঙালি জাতির অধিকারের দলিল, বহুল আকাঙ্ক্ষিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান।
আওয়ামী লীগ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মোট ৩১৩ আসনের পূর্ব-পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মোট ৩১০ আসনের মধ্যে ২৯৮টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীগণকে নির্বাচিত করে। কিন্তু তদানীন্তন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আওয়ামী লীগের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ না করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির পিতা ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ কালরাতে নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। এ ঘোষণা টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টার ও তৎকালীন ইপিআর- এর ওয়ারলেসের মাধ্যমে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এই ঘোষণা প্রচারিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল Proclamation of Independence, 1971 ঘোষণা করা হয়; যা অন্তর্বর্তীকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সংবিধান হিসেবে বিবেচিত। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে মন্ত্রী করে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে। শুরু হয় দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন এবং ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে Provisional Constitution of Bangladesh Order, 1972 জারি করেন; যা দ্বিতীয় সংবিধান নামে খ্যাত।
১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে Constituent Assembly of Bangladesh Order, 1972 জারি করা হয়। উক্ত আদেশের অধীন ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সদস্য ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে
গণপরিষদ গঠিত হয়। গণপরিষদকে সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয় ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল। ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে খসড়া সংবিধান বিল আকারে গণপরিষদে উত্থাপন করা হয়। ৪ নভেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান গণপরিষদে গৃহীত হয়। গণপরিষদে সংবিধানের ওপর বক্তব্য প্রদানকালে জাতির পিতা বলেন, ‘জনাব স্পিকার সাহেব, আজই প্রথম সাড়ে সাত কোটি বাঙালি তাদের শাসনতন্ত্র পেতে যাচ্ছে। বাংলার ইতিহাসে বোধ হয় এই প্রথম যে, বাঙালিরা তাদের নিজেদের শাসনতন্ত্র দিচ্ছে। বোধ হয় না, সত্যিই এটা প্রথম যে, বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিরা জনগণের ভোটের মারফতে এসে তাঁদের দেশের জন্য শাসনতন্ত্র দিচ্ছেন’। তিনি আরো বলেন, ‘এই শাসনতন্ত্রের জন্য কত সংগ্রাম হয়েছে এই দেশে। আজকে, আমার দল যে ওয়াদা করেছিল, তার এক অংশ পালিত হল। এটা জনতার শাসনতন্ত্র। যে কোন ভাল জিনিস না দেখলে, না গ্রহণ করলে, না ব্যবহার করলে হয় না, তার ফল বোঝা যায় না। ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়বাদ এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তাহলে আমার জীবন সার্থক হবে, শহিদের রক্তদান সার্থক হবে’।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন লালিত স্বপ্ন ছিল একটি সুখী-সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ গড়ার; যেখানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত হবে। বঙ্গবন্ধুর এই লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানের জন্যই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ঘোষণা করা হয় যে, রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন একটি শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে।
জাতির পিতা মাত্র ৩ বছর ৭ মাস ৩ দিন রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করেন। শূন্য হাতে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সহায়তা নিয়ে ছিন্নমূল মানুষকে পুনর্বাসন করেন, অবকাঠামো পুনস্থাপন ও উন্নয়ন করেন, এবং উৎপাদন খাত ও অর্থনীতিকে একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করান। বঙ্গবন্ধুর আমলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৯ শতাংশ অতিক্রম করে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, পরাজিত স্বাধীনতা বিরোধীরা ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ হত্যা করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে। শুরু হয় হত্যা, ক্যু আর ষড়যন্ত্রের রাজনীতি; থেমে যায় বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা।
দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে জয়ী হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়। আমরা দায়িত্ব নিয়েই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি প্রবর্তনের মাধ্যমে গরিব ও প্রান্তিক মানুষদের জীবনমান পরিবর্তনের মিশনে নেমে পড়ি। দেশকে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করি। দেশের প্রান্তিক মানুষের কাছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করি। আশ্রয়ণ প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে বাস্তুহারা মানুষের জন্য বাসস্থান নির্মাণ করি। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করি। মোবাইল ফোন এবং কম্পিউটার প্রযুক্তিকে সহজলভ্য করি। ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি স্বাক্ষর করি। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদন করি। আমাদের সরকারের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদকাল ছিল সকল পশ্চাৎপদতা, অনুন্নয়ন ও দারিদ্র্যের শৃঙ্খল ভেঙে অন্ধকার থেকে আলোকিত ভবিষ্যতের দিকে অভিযাত্রা।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত সবক’টি জাতীয় নির্বাচনে জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়ে ধারাবাহিকভাবে সরকার পরিচালনা করছে। ইতোমধ্যেই আমরা ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়ন করে
বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত করেছি। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করেছি। শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সেবার আওতায় নিয়ে এসেছি। সমুদ্রের বিশাল জলরাশিতে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে সুনীল অর্থনীতির দ্বার উন্মুক্ত করেছি। ভারতের সঙ্গে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ছিটমহলবাসীর দীর্ঘদিনের দুঃখ-দুর্দশার অবসান ঘটিয়েছি। আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছি। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৩য় টার্মিনাল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং কর্ণফুলীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের মতো মেগা প্রজেক্ট ইতোমধ্যে আমরা উদ্বোধন করেছি। আমরা মহাকাশে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছি। আমরা ২০ বছর মেয়াদি দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা অর্থাৎ ‘রূপকল্প-২০৪১’ বাস্তবায়ন করছি। আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ বাস্তবায়ন করছি। ২০৪১ সালের বাংলাদেশ হবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’।
আমরা জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের দর্শনে বিশ্বাসী। দেশের অগ্রগতিতে আমরা আশু, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সুদূরপ্রসারী এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অতি অল্প সময়ে সংবিধান প্রণয়ন বাঙালির জাতীয় জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং সংবিধানের চেতনা ধারণের জন্য জাতীয় সংবিধান দিবস পালন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে- এ আমার প্রত্যাশা।
আমি ‘জাতীয় সংবিধান দিবস-২০২৩’ এর সার্বিক সাফল্য কামনা করি।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।”

[wps_visitor_counter]