স্বীকৃতিতে কেন উপেক্ষিত নজরুল

প্রকাশিত : মে ২৫, ২০২৪ , ৬:৫৭ অপরাহ্ণ

‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না/কোলাহল করি সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না/ নিশ্চল নিশ্চুপ/ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধূর ধুপ ।’-এমন ধূপের মত নিভৃতে কাটিয়ে যাওয়া মানুষটি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মনের আকাশে আজও সুখের দ্যোতনা ছড়ান, সুরের ঝাণ্ডা ওড়ান । কথা হচ্ছে আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে । তার ভূমিকা শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে নয় বরং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে বাংলা ও বাঙালীর স্বাধিকার আদায়ের প্রতিটি মঞ্চে আজও তিনি প্রেরণার বাতিঘরের ভূমিকা পালন করেছেন । কখনো কলম হাতে, কখনো সুরের সাথে আবার কখনো-বা রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে । উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিমকে এক সুতোয় গাঁথার চেষ্টায় আত্ম-নিয়োগকারী মহান ব্যক্তিটির অসাম্প্রদায়িক চেতনা-প্রসূত কাব্য-গান-গদ্য বাঙালি জাতির জন্য বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ উপহার । মানুষের মুক্তির কথা বলতে গিয়ে যে মানুষটি শাসন-শোষণ ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে অকপট ও সোচ্চার থেকে অবিচলভাবে বলে গেছেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’-সে মহান ব্যক্তিকে আমরা আমাদের স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশত বছর পেরিয়ে যাওয়ার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে না পারায় আমাদের মানসিকতা ও রাষ্ট্রের দৈন্য-ভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছি । কোন অজ্ঞাত কারণে গণ-মানুষের কবি নজরুলকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির সাংবিধানিক স্বীকৃতি আজও প্রদান করা হয়নি তা সত্যিকারেই স্পষ্ট হওয়া দরকার ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, মহাপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ চেষ্টায় এবং বাংলাদেশের আগ্রহে ১৯৭২ সালের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে নজরুল ইসলামের জন্মদিনকে সামনে রেখে স্বপরিবারে তাকে ‘রাষ্ট্রীয় অতিথি’র মর্যাদায় স্থায়ীভাবে ও জাতীয় কবির অভিধা দিয়ে ঢাকায় আনা হয় । তেজগাঁও বিমানবন্দরে সেদিন বিপুল সংবর্ধনায় কবিকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান । ১৯৭৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয় এবং ২১ ফেব্রুয়ারি নজরুলের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের প্রীতি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার স্বীকৃতি হিসেবে সরকার নজরুলকে সাহিত্য ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত করা হয় । একই বছরের ২৪ মে কবির জন্মদিনে তাকে তদানীন্তন সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে আর্মি ক্রেস্ট উপহার দেয়া হয় এবং চল্ চল্ চল্ গানটিকে বাংলাদেশের রণসঙ্গীত ঘোষণা করা হয় । বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সে সময় পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কবির হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যখন দেশে সংস্কৃতির আগ্রাসন শুরু হয় তখন মাটি ও মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতির অভিভাবকত্ব করার জন্যই মূলত তিনি নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন । নানারকম চক্রান্ত আর অবহেলা, অসহযোগিতার কারণে ১৯৪২ সালে নির্বাক ও কবি তার ৩৪ বছরের অসুস্থ জীবনে কখনোই মাটি, মানুষ ও মানবতার জয়গান গাইতে ভুল করেননি । অনাদর অবহেলায় বেড়ে ওঠা কবিকে শেষমেশ আমরাও রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় কবির সাংবিধানিক স্বীকৃতি না দিয়ে তার প্রতি অকৃতজ্ঞতার মাত্রাকে দীর্ঘায়ত করেছি । শুধুমাত্র কাগজে কলমে নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তাকে জাতীয় কবি হিসেবে উল্লেখ করার পরেও তাকে সাংবিধানিকভাবে জাতীয় কবির মর্যাদা ও স্বীকৃতি না দেয়ার মানসিকতা নিঃসন্দেহে অশুভ লক্ষণ । দেশের কোটি মানুষের প্রাণের কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সাংবিধানিকভাবে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য তার ভক্ত-অনুরক্তদের এক-কণ্ঠ হওয়া আবশ্যক । রাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দিতে চাই, বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে কাজী নজরুলকে দেয়া জাতীয় কবির সেই ঘোষণা মানুষের হৃদয় মন্দিরে স্থান করে নিলেও আমাদের সংবিধানে সেটা স্থান না পাওয়া দুঃখজনক । রাষ্ট্রীয় গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে তাকে অদ্যাবধি জাতীয় কবির সাংবিধানিক স্বীকৃতি না দেয়া শুধু বড় রকমের একটি ‘জাতীয় ভুল’ই নয় বরং জাতীয় কবি নজরুলের জন্যও এটা অবমাননাকর বলে অনেকেই মনে করেন ।

১৯২৯ সালের ১০ ডিসেম্বর অবিভক্ত ভারতে কলকাতা এলবার্ট হলে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, এস ওয়াজেদ আলী, দীনেশ দাসসহ বহু বরেণ্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে যে কবিকে সমগ্র বাঙালির পক্ষ থেকে জাতীয় কাণ্ডারি ও জাতীয় কবির স্বীকৃতি দেয়া হয় সে কবিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুত জাতীয় কবির সাংবিধানিক স্বীকৃতি না দেয়াটা সত্যিকারেই রহস্যেভরা দুঃখের প্রাচীরসম । কালে কালে সাংবিধানিক স্বীকৃতিকে শাপলাকে জাতীয় ফুল, দোয়েলকে জাতীয় পাখি, রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে জাতীয় পশু, ইলিশকে জাতীয় মাছ, রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা গানকে জাতীয় সংগীত এবং সর্বশেষ আম গাছকে জাতীয় গাছের স্বীকৃতি দেয়া হলেও উপেক্ষিত রয়ে গেলেন কবি নজরুল । সাংবিধানিকভাবে জাতীয় কবির মুকুট এখনো অধরাই রয়ে গেল । অবশ্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জাতীয় কবির সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান সম্পর্কিত বিষয়ে বলেছেন, ‘নজরুল অগণিত মানুষের হৃদয়ে আছেন, দেশের সবাই জানে নজরুল জাতীয় কবি । কবিকে যে দেশ ও জাতি গভীরভাবে শ্রদ্ধা করে ভালোবাসে এটাই যথেষ্ট । তারপর আর আইনি স্বীকৃতি তেমন জরুরী নয় ।’ মাননীয় মন্ত্রী অবশ্যই যথার্থ বলেছেন । তিনিও যে নজরুলকে অসীম ভালোবাসেন তা তার অভিব্যক্তিতেই ফুটে উঠেছে । অবশ্যই এদেশের কোটি মানুষ নজরুলকে ভালোবাসে তবে নজরুল ভক্ত-অনুরক্তদের প্রাণের দাবী, নজরুলের প্রতি এদেশের মানুষের ভালোবাসাকে এবার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে সে ভালোবাসাকে দালিলিক করলে সেটাই বোধহয় মহোত্তম হবে । এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগ কামনা করছি ।

নজরুলকে নিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায়ের বিখ্যাত কবিতার এ পঙতি ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নিকে নজরুল ।’-দিয়েই সব কথা বলার শেষপ্রান্তে উপনীত হতে যাচ্ছি । সারাজীবন তিনি বলেছেন কুলি-মজুর ও নির্যাতিতের পক্ষে, সাম্য-শান্তি ও স্বাধীনতার পক্ষে, অজ্ঞানতা-কুসংস্কার ও অশান্তির বিরুদ্ধে । মাটি ও মানুষের কবি, প্রেম ও দ্রোহের কবি, গান-গীতালির কবি, ছন্দ-মিতালির কবিকে নিয়ে যে রহস্যের খেলা দীর্ঘকাল ধরে চলেছে তার অবসান ঘটিয়ে, চিন্তার দৈন্যভাব কটিয়ে এবার কবিকে জাতীয় কবির স্বীকৃতি দেয়া হোক; অবশ্যই সাংবিধানিক স্বীকৃতি । তিনিই আমাদের জাতীয় কবি, সার্বজনীন সংস্কৃতির বরপূত্রতুল্য মহাঋষী । প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধারণ করুক কার চিন্তার প্রতিচ্ছবি । তার যুক্তির শিক্ষা সবার হৃদয় লালন করুক । এখানে মুক্তি আছে, আছে বেদনা ঘুচানোর জল । মানুষের সাথে তাই মিশে আছে নজরুলের কবিতা-গান ।

রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।

raju69alive@gmail.com

[wps_visitor_counter]