অতিকথন শত বিপদের কারণ

প্রকাশিত : মে ২৬, ২০২৪ , ৯:১৯ অপরাহ্ণ

প্রতিকি চিত্র।

বেশি কথা বললে সে বেশি বিপদে পড়বে- এমনটাই তো হওয়ার কথা। কখন বলতে হবে এবং কখন থামতে হবে তার দিশা না থাকায় প্রিয়জন কমে এবং শত্রু বাড়ে। কথা তো সেই অস্ত্র যা একবার খাপছাড়া হলে তা আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। যার যত আপনজন বেড়েছে তা কথার কারণেই। যারা ছেড়ে গেছে তার জন্য দায়ীও ওই কথা! কথাতেই মানুষের উত্থান এবং কথাতেই পতন। মানুষকে মুগ্ধ করার জন্য, কারো বিশ্বাস অর্জনের জন্য এবং চির আপন হওয়ার জন্য কথার মত দক্ষ হাতিয়ার আর একটাও নাই। কিন্তু কথা যদি লাগামছাড়া হয়, কথা যদি কাউকে আঘাত করে কিংবা কথায় যদি দাম্ভিকতা-অহংকার বাসা বাঁধে তবে তা কথককে শ্রোতার হৃদয় থেকে মুছে দেয়। অর্থ, স্বার্থ কিংবা ক্ষমতা দিয়ে যা আদায় করা যায় না তাও কথা দিয়ে আদায় হয়। কথাতেই মানুষের মন জয় হয়। তবে কথা যদি কেবল কথার কথা হয় তবে তা তো বাজে কথাই হবে। অতিকথন মানুষকে লজ্জিত করে এবং শত বিপদের কারণ হয়।

কাউকে কোনদিন চুপ থাকার জন্য অনুশোচনা করতে হয়নি কিন্তু বেখাপ্পা কথার জন্য বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে। জ্ঞানী আত্মা লোকমান বলেছেন, “আমি আমার চুপ থাকার জন্য কখনোই অনুতপ্ত হইনি বরং আমার বলার কারণে বারবার অনুতপ্ত হয়েছি।“ উদ্ভট কথার জন্য সম্পর্কের যবনিকাপাত ঘটেছে, বন্ধন ছিঁড়ে গেছে এবং ক্ষমা চাইতে হয়েছে। কথার গ্যাঁড়াকলের নাকানিচুবানিতে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়নি এমন বাপের ব্যাটার অস্তিত্ব এখানে খুব কম আছে। লোকে বলে, কথায় কথা বাড়ে। ঝগড়ার সময় একপক্ষ থেমে গেলে ঝড় থেমে যায়। উত্তেজনার সময় একপক্ষ জিহ্বা দাঁতের পাটির মাঝে চেপে ধরলে শান্তি নাজিল হয়। কোথায় কী বলতে হবে এই বোধের অভাবে কত লোক নির্বোধ সাব্যস্ত হয়েছে, কতজন পেয়েছে নিন্দা তা এই বৃষ্টি-শোভিত রাতে মনে করে মনকে বিষিয়ে তুলতে চাইনে। পাঠকের কাছে প্রশ্ন থাকছে, বাড়তি কথা বলে বিপদ কী কম এসেছে? আরবি প্রবাদ বলে, ব্যক্তির কথা তার জ্ঞানের মাপকাঠি। বাংলার প্রবাদ হোক, বাজে কথাতেই আমরা মানুষের নির্বুদ্ধিতা মাপি!

একজন ভালো বক্তা জানে তার কখন থামতে হবে। একজন শ্রোতা আরও ভালো জানে বক্তার থেকে কতটুকু শুনতে হবে। পাঠক যদি এই পর্যন্ত না পৌঁছায় তবে শপথ- এ লেখকও ব্যর্থ লেখক! যে কথা মানুষকে মানুষের প্রিয়জন করে, যে কথা অচেনাকে ঘরে আনে কিংবা যে কথা শত্রুকেই বন্ধু করে সেই কথার ক্ষমতা খাটো করে দেখার সুযোগ নাই। তবে কথা যদি বস্তু-সারহীন হয়, বক্তা পাগলের প্রলাপ বকে তবে পৃথিবীর দূষণের মাত্রা আরও কিছু বাড়িয়েই গেল। একজন ভালো বক্তা একজন ভালো শ্রোতা। যে মন দিয়ে মানুষের কথা শোনে না, ধ্যান দিয়ে মানুষের ব্যথা বোঝে না কিংবা জ্ঞান দিয়ে ছলছল নয়নের ভাষা খোঁজে না সে ভালো বক্তা, নিপুণ গল্পকার কিংবা সার্থক কবি হতে পারে না। তিনিই তো শিল্পী যিনি মানুষের কোটি কথা জমিয়ে কালি ও কলমের আঁচড়ে নিখুঁত দৃশ্য-কল্পে একে দিতে পারেন। মানুষ আসলে শুনতে চায়, যিনি কবিতার মত কথা বলেন তার থেকে কথা! মানুষ আসলে জানতে চায়, প্রিয়জনের মনের কথা।

শুধু মানুষেই কথা বলতে জানে না! আকাশের চাঁদ, তারাদের জ্যোছনা, নীড়ে ফেরা পাখি, ঘাসের গায়ে বাতাসের ঢেউ কিংবা ঝিঁঝিপোকা, সাগরের ঢেউ কিংবা পাখির ডানা মেলা- এসবও কথা। যার অর্থ আছে, যেটা কিছু বোঝায় তাই তো ভাষা! কোকিলের কুহুতান, ঝাউয়ের শন শন কিংবা নুপুরের রিনিঝিনি কিংবা টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটা এসবেও মন আন্দোলিত করে। মন্দ লোকের অর্থহীন বকবকানির চেয়ে গরুর হাম্বা হাম্বা বেশি অর্থপূর্ণ! পাপীর মুখে ধর্মের কড়চা থেকে নদীর কলতান বেশি পবিত্র। যে কথায় শত্রুতা বাড়ায়, যে কথা সত্য আড়াল করে কিংবা যে কথায় বেদনার নীলাচল পতপত করে ওড়ায়- মানুষের কান সেসব ধ্বনি থেকে বিরত থাকলেই বরং এবাদত হবে। যে কথা পথহারার কল্যাণে আসে না, যে শব্দ দিশা-হীনকে ঠিকানা দেয় না সে কথার কাফন ছাড়াই দাফন হয়ে যায়। মানুষ যেটুকু বলে তা যেন সুন্দর করে বলে। মানুষ যেটুকু শোনে তা যেন কল্যাণের জন্য শোনে।

অতিরিক্ত কথার ধারক-বাহককে বাচাল বলে। যে কথা কেউ পছন্দ করে না তাতে প্রলোভন থাকে। সে কথায় মধুরতা মিশিয়ে বাজারে বেচতে হয়। কাজেই যে কথা মনের লেনদেনে কিনবেন সে কথা যাচাই ছাড়া থলেতে ভরবেন না। একটা খারাপ কথায় আপনার ভালো থাকা নষ্ট হয়ে যাবে। একটা খারাপ শব্দ দুঃখের কারণ হয়ে হাজির হবে। কত কত ভালো কথা আছে সেগুলো শুনুন। সে রস মাখা কথা যা আপনাকে ডোবাবে, যে প্রলোভনের স্বর যা আপনাকে ব্যথা দিবে সেসব এড়িয়ে চলুন। মেপে কথা বলুন। সীমিত কথা শুনুন। ভালো কথা রাতভর শুনতেও দোষ নাই কিন্তু একটা অর্থহীন কথা শোনা মানে শ্রবণেন্দ্রিয়ের ক্ষতিসাধন করা। বাজে কথা মনে রাখা মানে মস্তিষ্কের একটা গুরুত্বপূর্ণ সেল নষ্ট করা। দুষ্টের কথা মন দিয়ে শোনা মানে মনকে বিষিয়ে তোলা! কে কী বললো তার চেয়েও জরুরী আমি কী শুনলাম!

রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
raju69alive@gmail.com

 

[wps_visitor_counter]