দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ হোক নতুন সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৬, ২০২৪ , ৩:১৪ অপরাহ্ণ

আসন্ন রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে কিনা-সাধারণ মানুষের মধ্যে অনন্ত জিজ্ঞাসা। অন্যদিকে নতুন সরকারকে যে কয়টি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে তার মধ্যে অন্যতম দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা। নতুন মন্ত্রীসভা গঠনের দিনেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের রাখার ওপর জোর দিয়েছেন। দল-বিদল, আমজনতা নির্বিশেষে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সবার ঘাম জড়িয়ে ছাড়ছে। জীবন ছড়াচ্ছে নাভিশ্বাস। দেশের বাজারে সস্তা বলতে এখন কিছুই নাই! আয়ের সাথে সংসারের ব্যয়কে সামঞ্জস্য বিধান কঠিন হয়ে পড়েছে। যাবতীয় ব্যয়ভার মিটিয়ে ভবিষ্যতের জন্য সামান্য সঞ্চয় করতে পারছে, এমন কর্মজীবী ও পরিবারের সংখ্যা অল্পই। বাজারের ব্যাগ নিয়ে হিমশিম খাওয়া মানুষের গল্প তরকারির পাতিল জানে!

দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন বৃদ্ধির বিষয়টি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের জন্য মাথা ব্যথার বড় কারণ হয়েছে। দেশি-বিদেশি চাপ-ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে সেখানে দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে তীব্র সমালোচনায় নতুন সরকারের সামনের দিনগুলো কঠিন হতে যাচ্ছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে বাজার মূল্যের তুলনা করলেও আঁতকে উঠতে হয়। আলুর ভরা মওসুমে, সিম-কপির উৎপাদনকালে বাজারে পঞ্চাশ টাকার নিচে সবজি আছে সামান্যই। পেঁয়াজ, খোলা সয়াবিন, ছোলা, চিনি, মসুর ডাল এবং খেজুরের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। রমজানকে সামনে রেখে অসৎ ব্যবসায়ী-চক্র নিত্য-পণ্যের দাম বৃদ্ধির নতুনভাবে পাঁয়তারা শুরু করেছে।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করার বিকল্প নাই। বাজারে বেশিরভাগ পণ্যের সংকট নাই, সরবরাহ স্বাভাবিক অথচ সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে কৃষকের হাত বদল হয়ে বাজারে ক্রেতার ব্যাগ পর্যন্ত পৌঁছাতে পণ্যের দাম দ্বিগুণ-তিনগুণ বেড়ে যায়। মধ্য-স্বত্বভোগীদের এই নীতি-হীন কার্যক্রম বন্ধ করতে না পারলে সরকারের স্বস্তি আসবে না এবং জনগণের ভোগান্তিও কমবে না। নির্বাচনের পূর্বে গরুর মাংসের কেজি ৬০০ টাকায় নেমে আসলেও নির্বাচন যেতে না যেতেই সেটা ৭০০ টাকা কেজি হয়ে যাওয়াকে স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নাই। কৃষক যে আলু ২৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করছে সেই আলু বাজারে আসতে আসতে ৭০ টাকা হয়ে যাওয়ার পিছনে কারো না কারো কারসাজি তো নিশ্চয়ই আছে। পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম, চালোর বাজারে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টাও চলছে। ইতোমধ্যেই ৭ থেকে ৮ টাকা কেজিতে বেড়েছে!

রমজানের পূর্বে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করার রেওয়াজ অসাধু ব্যবসায়ীদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। রোজার দিনগুলোতে সে সকল পণ্য বেশি ব্যবহার্য হয়ে ওঠে-ছোলা, ভোজ্য-তেল, চিনি, পেঁয়াজ, মসুর ডাল এবং খেজুর নিয়ে ইতোমধ্যেই নাটকীয়তা শুরু হয়েছে। সরকার যতভাবে কঠোর হচ্ছে, স্থানীয় বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে, জরিমানা করছে-তাতে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসছে না। অসাধু ব্যবসায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে, মজুদদারদের চিহ্নিত করে সাজার আওতায় না আনতে পারলে, পরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্য বন্ধ করা না গেলে, পথে পথে চাঁদাবাজদের রুখে দিতে না পারলে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা যাবে না এবং জনজীবনে স্বস্তি আসবে না। সরকারের ওপর মানুষের যতগুলো কারণে মন খারাপ তার সিংহভাগে বাজার ব্যবস্থায় অনিয়ন্ত্রন দায়ী।

দ্রব্যমূল্যের যে লেলিহান উর্ধ্বগামিতা তা মানুষের প্রত্যাশা ও সক্ষমতার মুলে কুঠারাঘাত করছে। সরকার দলীয় শিথিলতায় হোক কিংবা বিরোধীদলের চক্রান্ত হোক অসাধু ব্যবসায়ীদের এই যে নীতি-হীন মুনাফা-লোভ এর দায় সরকারকেই নিতে হবে। সকল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিশ্চয়তা মানুষের মৌলিক অধিকার। চাষের মাছ ও ফার্মের মুরগীর দাম সপ্তাহে সপ্তাহে বাড়ছে। কাজেই পিছিয়ে থাকা বিশাল-গোষ্ঠীর একটি প্রজন্ম পুষ্টি-হীনতা নিয়ে বেড়ে উঠছে। রাষ্ট্রকে কি অদূর ভবিষ্যতে সেটার খেসারত দিতে হবে না?

তথ্য প্রবাহের অবাধ স্বাধীনতার যুগে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের দ্রব্যমূল্যের সাথে আমাদের বাজারের দ্রব্যমূল্য তুলনা করলে হতাশ হতে হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশে রমজান মাসে যখন বড় অঙ্কের ছাড় দিয়ে সব পণ্য বিক্রি হয়, সেখানে আমাদের দেশে একশ্রেণীর ব্যবসায়ীরা সারা বছরের ব্যবসা রমজান মাসে উসুল করতে উঠেপড়ে লাগে। নৈতিকতা-বোধের অবক্ষয়ে যে হালচাল শুরু হয়েছে তাতে মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার ধারণা থেকে আমাদের অবস্থান দূর থেকে আরও বহুদূরে যাচ্ছে। স্মরণকালের কোন রমজান মাসেই মানুষ স্বস্তি-দায়ক ইবাদত-বন্দেগীতে মনোনিবেশ করতে পারেনি। বাজার ব্যবস্থাই এক ধরণের আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে।

গণ-কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য রুখে দেয়ার বিকল্প সরকারের আছে আপাতত কিছুই নাই। নয়তো রাতারাতি ডিমের হালিতে ১০ টাকা বেড়ে যাওয়া, পেঁয়াজের সেরে শ’টাকা টাকা বৃদ্ধি পাওয়া, চলের দরে কেজিতে রাতের ব্যবধানে ৮-১০ টাকা বৃদ্ধির দৃষ্টান্ত বিশ্বের অন্যকোন দেশে আছে বলে জানা নাই। ব্যবসায়ীদের অল্প সময়ে কোটিপতি হওয়ার যে প্রবৃত্তি সেটা আইনের প্রয়োগেই বন্ধ করতে হবে। কোন রাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের নীতি-বোধ পঁচে গেলে সেটার খেসারত সবাইকেই দিতে হয়। বর্তমানে বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করলে সেটাই প্রতীয়মান হচ্ছে। সাধারণ মানুষের নিরাপদ জীবনের জন্য, অল্প আয়ের মানুষের দুশ্চিন্তাহীন জীবনের জন্য নতুন সরকারের সর্বপ্রথম এবং সর্বাধিক প্রধান্যের বিষয় হোক-দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। বাজার ব্যবস্থার মনিটরিং নিয়মিতভাবে নিশ্চিত করতে হবে।

রাজু আহমেদ।
কলাম লেখক।
[email protected]

[wps_visitor_counter]