যোগ্যদের যোগ্যতা বিনয়ে

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৪ , ২:৪৬ অপরাহ্ণ

কথায় কথায় ধমক দেয়া, কাউকে মূল্যায়ন না করা, তোয়াক্কা না করার মানসিকতা কিংবা কারো মতামতকে গুরুত্ব না দেওয়া মানুষগুলোর বেশিরভাগ সাধারণত অযোগ্য হয়। অথচ যারা যোগ্যতাসম্পন্ন তাদের ভূষণই হচ্ছে বিনয়। কেউ ভুল করলেও তারা শুধরে দেয়, বকা দিতে হলেও হাসিমুখে বলে, এটা এভাবে না করে এমনভাবে করলে ভালো হতো! সবাইকে তটস্থ রেখে, গলার স্বর উচ্চ রেখে কিংবা আগ্রাসী মনোভাবে যারা কাজ আদায় করতে চায় তারা শেষমেশ মানুষের মন থেকে হারিয়ে যায়। কোথাও থাকতে হলে ভালোবেসে ভালোবাসায় থাকাটা জরুরি। ভালোবেসে শাসন করতে পারাটাও যোগ্যতা! কটু কথা বলে, হুমকি-ধমকি দিয়ে কিংবা গালাগালি যোগে জীবন থেকে ভালোত্বের বিয়োগ ঘটে।

ক্লাসের প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীদের বড়াই থাকে না, একজন কাজ জানা দক্ষ মানুষের অহংকার থাকে না কিংবা একজন সফল বস আত্ম-অহমিকায় ভোগে না। যার অযোগ্যতা যতবেশি সে অন্যের ততবেশি ভুল পায়, মানুষকে আঘাত করে তৃপ্তি পায়, মানুষের ভুল ধরে সুখ পায়! যে মানুষের দুর্বলতায় আঘাত করে সে মানুষের পারিবারিক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক আচার এবং মানসিক বিকাশের অভাব আছে। ঔদ্ধত্য-অহংকার কখনোই মানুষকে জ্ঞানের পথে পরিচালিত করে না। ক্ষমতার দম্ভে যে বড়াই জন্মে সেটা মানুষকে ধ্বংসের কিনারার টেনে নেয়। অহমিকা কাউকে বড় করে এমন দৃষ্টান্ত দুর্লভ।

যিনি যতবেশি বিনয়ী হয়েছেন, কৃতজ্ঞতায় নত রেখেছেন মস্তক, অজ্ঞতার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন কিংবা নিজেকে জাহির করেছেন সামান্য হিসেবে তিনি ততবড় হতে পেরেছেন। কখনো কখনো সামাজিক মূল্যায়নে, সামগ্রিক স্বীকৃতিতে বিনীত মানুষগুলোকে পিছিয়ে রাখার প্রবণতা থাকে কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ার গতিতে যোগ্যরা যোগ্য-স্থান স্পর্শ করে! মানুষের অন্তরে ভালোবাসার যে সম্মান মেলে তা ধন-সম্পদের দ্বারা পাওয়া যায় না। একেকজন বিনয়ী মানুষ একেকটি বাতিঘর। আশার বৃক্ষ! ফলবান বৃক্ষ যেমন শাখা-প্রশাখায় মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ে তেমনি একজন বিনয়ী মানুষের মাথা মাটিতে স্পর্শ করে। জমিনে তাদের পদচিহ্ন বিনীত স্বভাবের হয়। তাদের ভাষা মার্জিত হয়। কথা কোমল হয়। তাদের উপস্থিতি অনাড়ম্বর হয় অথচ চারপাশ আপন আলোয় উদ্ভাসিত করে।

অর্জনে যাদের অহংকার বাড়ে, মানুষকে সম্মান করতে ভুলে যায়, আত্ম অহমিকায় আপনজনদেরকেও চিনতে পারে না কিংবা প্রিয়জনদের সাথেও বেড়ে যায় দূরত্ব তাদের জীবন ধীরে ধীরে নরকের মত বিষিয়ে ওঠে। তাদের বন্ধু কমে যায়। সুহৃদয় সহমর্মীর দুর্ভিক্ষে ভোগে। যিনি নিজেকে যতবেশি বড় ভাবেন তিনি আসলে ততটাই ক্ষুদ্র! এ-ই বোধটুকুর জন্ম না হওয়ায় মানুষ মানুষের সাথে খারাপ আচরণ করতে পারে, কথায় কথায় ব্যথা দিতে পারে এবং কথা-কাজে দম্ভ প্রকাশিত করতে পারে।

একজন ভালো মানুষের যা যা আভরণ, সেখানে অহংকার-অহমিকা সেসবের বিপরীত বদগুণ। কারো ক্ষমতা যতবেশি হোক, শিক্ষা যত উচ্চমার্গের হোক, চেয়ার যত চওড়া হোক কিংবা অর্থ-বিত্ত যত পুরু হোক, তার যদি বিনয় না থাকে, মানুষকে গুরুত্ব দেওয়ার মানসিকতা না থাকে, কথা শোনার ধৈর্য না থাকে কিংবা মেশার অভ্যাস না থাকে তবে তার আসলে কিছুই নাই! টাকা-পয়সার হাতবদল হয় কিন্তু বিনয়ের সুফল মৃত্যুর পরেও মানুষের সাথে থেকে যায়।

মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টাটা জরুরি। যে মানুষের কাছে মানুষের বর্ণ তথা সাদা-কালোর আলাদা গুরুত্ব নাই, মনুষ্যত্বের মাপকাঠিতে আমির-ফকিরের মাঝে তফাত করে না, দায়িত্ব পালনে নৈতিকতা-অনৈতিকতার পার্থক্য ভোলে না, জীবনাচারে সত্য-মিথ্যা একচোখা দৈত্যের মত দেখে না সেই মানুষ বিনীত না হয়ে পারে না। যারা ভুল হলে বুঝতে পারা মাত্র দুঃখিত হয়, ক্ষতি পুষিয়ে দেয় তারাই শ্রেষ্ঠ মানুষ, নিঃসন্দেহে ভালোমানুষ। যারা অহংকারী তাদেরকে যেমন-ভাবে মানুষেরা পছন্দ করে না, ভালোবাসা পায় না, তেমনিভাবে স্রষ্টাও অহংকারীকে অপছন্দ করেন এবং তাদের থেকে বরকত-রহমত তুলে নেন। সেজন্যই সফলতার চূড়া থেকেও কেউ কেউ ভূপাতিত হয়, লাঞ্ছিত হয়।

খুব বেশি বড় হওয়ার দরকার নাই, জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিনয়ী হোন। বিনয় আপনাকে বড় করবে। মানুষের ভালোবাসা অর্জনের মাঝে যে তৃপ্তি তা উদ্যত-অহংকারী কোনদিন উপলব্ধি করতে পারবে না! বিনয়ী হলে শত্রু কমে আসবে, মানসিক অস্থিরতা কমে যাবে।অপ্রাপ্তি-অতৃপ্তির যে অস্বস্তি সেটা জয় করতে পারবেন। বিনয়ের মোড়কে জড়ানো যোগ্যতা হলে আপনার বাকিসব অযোগ্যতার দুর্নাম মুছে যাবে। মানুষ আপনাকে হৃদয়ে রাখবে, ভালবাসবে। কেউ আপনাকে সসম্মানে মনে রাখছে-মানবজীবনের এর চেয়ে বড় পুণ্য ও পূর্ণতা আর কোথাও, আর কিছুতেই নাই। অহংকারে পোশাক খুলে বিনয়ের চাদর জড়িয়ে নিলে মানবজীবন ধন্য হবে। তাতে মানুষের মর্যাদাও অগ্রগণ্য হবে।

রাজু আহমেদ।
কলাম লেখক।
[email protected]

[wps_visitor_counter]