বোধ বেচে দিয়ে বাঁচা যায় না

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৪ , ১১:৩৩ অপরাহ্ণ

প্রতিকি চিত্র।

এক!
যারা ভিডিও বার্তায় সাংসারিক সমস্যার কথা বলে কাঁদে, ডিভোর্সের জন্য সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীকে জানায়, বেডরুমকে আউটডোরে নিয়ে এসে সিমপ্যাথি সেকের খেলা করে তারা আসলে সবাইকে এসব কেন জানায়? তারা কি তাদের বিবাহের সময় সবাইকে দাওয়াত দিয়েছিল? তাদের অরুচিকর কর্মকাণ্ডের মহামারীতে গোটা সমাজব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েছে! মিডিয়া ডিভোর্সের সংখ্যা আর বিবাহের সংখ্যা নিয়ে বাণিজ্য করেই কোটি টাকা ইনকাম করে ফেলে! অথচ সমাজের কি পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তার পরিমাপ ধান্ধা-বাজদের কাছে নাই!

এই যে ইস্যু কেন্দ্রিক জীবনাচার এটা মাতলামির উচ্চমার্গে পৌঁছেছে। তিনদিন আগে যে ইস্যু মনোরাজ্য উতলা করেছিল তা আরেক ইস্যুর চাপে টিস্যুতে পরিণত হয়েছে। সমাজের যেসব ক্ষত নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার সেসব বিষয়ে কারো কোন কথা নাই! চর্চার কেন্দ্রবিন্দু আবর্জনা! যার দুর্গন্ধে মানসিকতা বিষাক্ত হচ্ছে, মানবিকতা হারিয়ে যাচ্ছে, সম্মান-শ্রদ্ধাবোধ উঠে যাচ্ছে! লোভ-ভোগের ধ্বংসযজ্ঞ ধেয়ে আসছে!

অসুস্থতা যে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা শর্টস, রিলস, টিকটক, কাপল ব্লগিং না দেখলে আন্দাজ করাও মুশকিল! মনুষ্যত্ব, গোপনীয়তা, পবিত্রতা বলে আর কিছুই অবশিষ্ট নাই! সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য দেহ উন্মুক্ত করছে, বেফাঁস কথা বলছে এবং অশ্লীলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে! আত্মসম্মানবোধ থাকলে ডিভোর্স গোপন পরিসরে হওয়া উচিত! বেডরুমের কারবার চার-দেয়ালে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত! ব্যক্তি জীবন ব্যক্তিত্বের গণ্ডিতে থাকা দরকার!

আমাদের এমন একটা প্রজন্ম আছে যার একাংশ মনো-বৈকল্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে! অনলাইনে এদের অসুস্থ দৌরাত্ম্য বিষ-বাষ্প ছড়াচ্ছে! অফলাইনেও এরা বখে গেছে! গ্যাং কালচারে জড়িয়েছে! পারিবারিক যত অশান্তি তা সৃষ্টির হোতা এরাই! সামাজিক বিশৃঙ্খলায় এরা দায়ী! এদের আদর্শ মিডিয়ার উম্মাদ তারকা! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সস্তা জনপ্রিয় ব্যক্তি! যাদের বাস্তব জীবনে কোন বন্ধন কিংবা অর্জন নাই!

দুই!
কে কোন বয়সে কাকে বিয়ে করবে সেটা বাইরের কেউ নির্ধারণ করে দিতে পারে না। যখন আলোচনার কোন ইস্যু থাকে না, কথার রুচিতে দুর্ভিক্ষ হয় তখন এসব বিষয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়! তিশা-মোস্তাকদের বাড়াবাড়িটা একটু বেশি! দু’জনেই বয়সের ফ্রেমে অবুঝের কাতারে পড়েছে! একজন বুড়ো শালিকের গাড়ে রোঁ’র ভীমরতিতে অবুঝ আরেকজন লোভ-চাকচিক্য-মোহের কারনে অবুঝ! বইমেলায় প্রকাশিত তাদের বইয়ের সূচিপত্র দেখে তাদেরকে অবুঝের সাথে সাথে আরও কঠিন কিছুও বলতে ইচ্ছা করে! সব কথা যে যায় না বলা সহজে!

এই বই মেলায় যে সকল লেখক ও বই বইমেলাকে তুচ্ছ বানিয়েছে তার মধ্যে এই দম্পতি ও তাদের বই শীর্ষে! কর্তৃপক্ষকে এই মহৎ আয়োজনের ভাবমূর্তি ধরে রাখার স্বার্থে আরেকটু সচেতন হতে হবে। কঠোরতা তো বটেই। যে বই আবর্জনা, যে লেখকদের মস্তিষ্ক বিকৃত তাদের বই বাংলা একাডেমির মহৎ উদ্যোগকেও কৈফিয়ত তলব করে! রুচির দুর্ভিক্ষকে প্রলম্বিত না করে কি করে ভালোর প্রচার বাড়ানো যায় সেই চেষ্টা জোরালো-ভাবে হোক।

মোস্তাক-তিশার মত বহু অসম বয়সের বিবাহ দেশে পূর্বেও ছিল! তবে মাতামাতি কখনোই এমন চরম পর্যায়ে ছিল না! মানসিক অসুখ যে সংক্রামক তা এইসব দৌরাত্ম্য দেখে মালুম করা যাচ্ছে! ইউটিউবাররা ভিউ বাড়ানোর জন্য পাগলামিতে মদদ দিচ্ছে, টিআরপিহীন টেলিভিশন, অপ্রচলিত পত্রিকা এই ইস্যুগুলোকে রঙচঙে প্রকাশ-প্রচার করছে! সুগার ড্যাডিদের দ্বারা সমাজের ক্যান্সার-তুল্য ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ছে! কোথাও কোথাও লোভের ঢেউ মাথাচাড়া দিচ্ছে!

তিন!
আমাদের এতটুকু আত্মসম্মানবোধ অর্জিত হোক যাতে কোন সস্তা জনপ্রিয় তারকার সাথে ছবি তোলার জন্য, তার সাথে দেখা করার জন্য, একটু ছোঁয়া পাওয়ার জন্য আগ্রহ না জাগে কিংবা উম্মাদ না হই। কাপল ব্লগিং বা অনুরূপ কোন নামে নিজের বেডরুমের গোপন মুহূর্তগুলো, একান্ত সময়গুলো যাতে বিক্রি করে অর্থ কামাইয়ের ইচ্ছা না জাগে সেই স্বাবলম্বিতাটুকু অর্জন হোক। কালের কোলে বিকিয়ে দিয়ে অসুস্থ পথে জনপ্রিয়তা অর্জনের কোন কর্মকাণ্ডে যেন জড়িয়ে না যাই, কোন নেগেটিভ চরিত্রের দ্বারা আমাকে যাতে কেউ না চেনে সে চেষ্টাটুকু সর্বত্র ও সর্বক্ষণ থাকুক।

অন্যের পরিচয়ে যেন বড় হতে না হয়, আত্মীয়-স্বজনের পদ ও পদবীকে যাতে জীবনধারণের উপায় করতে না হয় সেই যোগ্যতা ও পরিচয় নিজের হোক। সেজন্য পরিশ্রমী, অধ্যবসায়ী হতেই হবে। আদর্শ ঠিক করে তাকে অনুসরণ করতে হবে। দুর্নীতিবাজ, বাটপার, অযোগ্য কিংবা অবৈধ ক্ষমতাবানদের কাছে যাতে মাথা নত করতে না হয়, গোলামি করে স্বার্থ আদায় করতে না হয় সেটুকু ন্যায়-বোধসম্পন্ন হতেই হবে। এতটুকু চিন্তাশীল হোন যাতে আপনি বুঝতে পারেন, হিরো আলম, মোস্তাক-তিষা, ডাঃ সাবরিণা, সেলেব্রিটি ক্রিকেট লীগের ঐ মেয়ে, কিংবা লুবনাদের অধিকার নিয়ে কথা বলার চেয়ে সমাজের মৌলিক কাঠামো, ম্যাক্রো লেভেলের সামাজিক সমস্যা নিয়ে কথা বলা জরুরি।

অসুস্থতার অন্যায় রুখে দিতে বিপ্লব ঘটাতে হবে। মন ও মননে সুস্থ মানুষ হতে না পারলে এই জীবনের বিন্দুমাত্র মূল্য নাই! সমাজের বখে যাওয়া, নষ্ট হওয়াদের কেউ যদি আমার আদর্শ হয় তবে আমার জীবিত থাকা আর না থাকায় কোন তফাৎ নাই। একটা সুস্থ-স্বাভাবিক সংসার-সমাজের জন্য সস্তা সেলেব্রিটি এবং মোস্তাক গং-দের মত লেখকদের চিন্তার সংস্পর্শ থেকে যোজন যোজন দূরে থাকতে হবে। প্রয়োজনে চোখ বন্ধ রাখতে হবে, কান বন্ধ রাখতে হবে তবুও অসুস্থতা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। বোধ বেচে দিয়ে বাঁচা যায় না!

রাজু আহমেদ। প্রাবন্ধিক।
[email protected]

[wps_visitor_counter]