অনেকেই একা

প্রকাশিত : মার্চ ৮, ২০২৪ , ১১:১৬ অপরাহ্ণ

প্রতিকি চিত্র।

হাজারো মানুষের মধ্যে কাটিয়ে, ব্যস্ততায় সারাদিন লুটিয়ে, বহু-কিছু ঘটিয়েও কেউ কেউ দিন শেষে একা! সুখ ভাগাভাগি করার মানুষ নাই, দুঃখের সময়ে পাশে থাকার মত ছায়া নাই। একসাথে গল্প বলার, দু’কাপ চায়ে পাশাপাশি বসার, রাতভরে জোছনা দেখার, মিলেমিশে বৃষ্টির শব্দ শোনার কিংবা ভরসা করার মত কোথাও কেউ নাই। পাশাপাশি তবুও যেন দূর-বহুদূর। কেউ কারো মনের খবর পর্যন্ত জানে না। যেন জীবন্ত দু’টি কবর পাশাপাশি চলছে। কেউ কারো প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে ফিরেও তাকাচ্ছে না। মান-অভিমানের কোন দাম নাই। অদৃশ্য দেয়ালে আড়াল হয়েছে মুখ। ইচ্ছা-অনিচ্ছা অসময়ে একা একা আসে আবার সময়ের আগে একাই চলে যায়।

একাকীত্ব নিজে কোন অসুখ নয় তবে বহু অসুখের মাতাপিতা। একাকীত্বে কাটাতে কাটাতে একসময় জীবনের ওপর প্রবল ঘৃণা জন্মে। জীবনটাকে অসাড় মনে হয়। সুযোগ পেলে চরিত্র নষ্ট করে। ভ্রষ্ট পথের ভুল ভাবনায় জীবন ফুরিয়ে ফেলে। আত্মহননের চেষ্টাও প্রবল করে। গোটা জীবনের সুখ-শখ পুড়িয়ে দেয়। যখন একাকীত্ব থামে তখন সামনে কবর ছাড়া আর বিকল্প কোন আশ্রয় মেলে না। মানুষ আসলে একা থাকার জন্য জন্মায়নি। স্বভাবে সে একা হয়! জেদ-ক্ষোভে যে বিচ্ছিন্ন হয় প্রিয়জনের বহুডোর থেকে। যখন অতীতে তাকায় তখন ভুল ধরা পরে কিন্তু প্রায়শ্চিত্তের ক্ষণ আর অবশিষ্ট থাকে না।

আবার চারদিকে কেউ নাই-মাত্র দু’প্রান্তে দু’জন অথচ সুখ-নির্ভর নির্ভাবনায় কেটে যাচ্ছে সময়। তাদের কাছে এই একটা জীবন খুব সংক্ষিপ্ত মনে হয়। ভালোবাসার জন্য, দু’জনে মিশে থাকার জন্য জীবনের আয়ু আরও দীর্ঘ হলেই ভালো হত। দু’জনে যদি একসাথে আরও বহু-জীবন পাওয়া যেতো! একজোড়া ঘুঘুর মত বাসা বাঁধত, একজোড়া শালিকের মত উড়ে বেড়াত, একজোড়া পথের মত পাশাপাশি বয়ে চলত কিংবা একজোড়া নদীর মত আবার মিলিত হতো! এমন প্রাণোচ্ছল জীবনের চেয়ে আর সুখের মুহূর্ত হয় না। মনে মনে সন্ধি পাতা বন্ধন আজীবন মনের মানুষের জন্যই অপেক্ষা করতেও সুখ পায়।

যারা ভোগের চেয়ে ত্যাগে মানসিক প্রশান্তি অনুভব করে তাদের একা হতে হয় না। যারা অপরের দোষের মত নিজের ত্রুটিও সমানভাবে দেখে, তাদেরকে কেউ ছেড়ে যায় না। জীবন প্রতি যাদের অভিযোগ-অনুযোগ কম, যারা অল্পে তুষ্ট হয়, গল্পে সুখ পায় তাদেরকে রাত পুড়িয়ে চোখের জল মুছতে হয় না। সম্পর্কে আমিত্ব-বড়ত্বের ছায়া কেটে গেলে, সুখ-দুঃখ সমানভাবে বুঝলে, চোখের ভাষা খোঁজার ধৈর্য রাখলে, মানুষ তাকে একা ফেলে যায় না। বরং তার সাথে মিশে থাকতে পারলে সে জীবনকে ধন্য মনে করে। ধীরে ধীরে সেটা মহৎ জীবনে প্রবেশ করতে শুরু করে।

একাকীত্বে কিংবা সাহচর্যে-দু’ভাবেই জীবন বয়ে যাবে। তবে যে জীবন যন্ত্রণা দেয়, বিরহে পোড়ায় সে জীবনের গণ্ডি থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়। ভরসা করার মত, বিশ্বাস রাখার মত কিংবা পাশাপাশি থাকার মানুষ পেলে এই জীবনে আর কি লাগে? মতাদর্শের দ্বন্দ্ব কোন সমস্যা নয়, সমস্যা যা তা হচ্ছে সহনশীলতার অভাব। বুঝতে চাওয়া এবং বোঝানোর মানসিকতার ঘাটতি। নিজের যুক্তিকে যথার্থ ভেবে অন্যকে সহ্য করার বোধের অভাব। আমিই কেবল সঠিক-এই রীতি জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে। আমার স্বার্থ আগে-এই মনোভাব জীবন থেকে জীবনকে দূরে টেনে রাখে। বোঝাপড়ার বন্ধন দৃঢ় হওয়া খুব জরুরী।

ইচ্ছা করে যদি ভুলের আটি মোটা করি তবে তা শোধরানোর জন্য এই পৃথিবীতে আরেকটি জীবন পাবো? যেদিন ফুরিয়ে যায় সেদিনের মত আরেকটি বাড়তি দিন? কোথাও নত হয়ে, কোথাও যুক্তি দিয়ে তবেই মুক্তির পথ বের করতে হবে। শান্তির জন্য সর্বাগ্রে দরকার সন্ধি এবং প্রতিশ্রুতি পূরণের ইচ্ছা। কারো কাছে ক্ষমা চাওয়া সবচেয়ে বৃহৎ ও মর্যাদাপূর্ণ মানবিক ক্ষমতা। মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। কাজেই জীবনের সাথে জড়িয়ে যাওয়া মানুষগুলোর সাথে কীভাবে ভালো থাকা যায়, সময়গুলোর সর্বোত্তম ব্যবহার করা যায়, গল্পের আসর আরও দীর্ঘ করা যায় সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক। জীবনের বেলা ফুরিয়ে এলে যেন আফসোস করতে না হয়-এমনটা না করলেও পারতাম! বরং ভুলগুলো তার উৎসেই শুধরে যাক। পুষ্প-পল্লবে মুখর হোক জীবন। ভ্রমর এবং পাখির কলকাকলি হয়ে উঠুক শান্তির সমাবেশের সংগীত।

রাজু আহমেদ। প্রাবন্ধিক।
[email protected]

[wps_visitor_counter]